ছৈয়দ আহমদ তানশীর উদ্দীন:
২০১৩ সন থেকে জাতিসংঘ ১৯ নভেম্বরকে ‘ওয়ার্ল্ড টয়লেট ডে’ হিসেবে ঘোষণা দেয়। অনেকের নিকট ‘বিশ্ব টয়লেট দিবস’ ঘোষণাকে অদ্ভুত ও বিস্ময়কর মনে হতে পারে, কিন্তু একটি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন টয়লেট মানব জীবনে যে কতটুকু গুরুত্বপূর্ণ সে ব্যাপারে জনগণকে সচেতন করতে জাতিসংঘের ‘টয়লেট ডে’ ঘোষণা অপরিহার্য ছিল।

সারাবিশ্বে এখনও ৩৭ শতাংশ মানুষ পরিচ্ছন্ন টয়লেটের সুবিধা থেকে বঞ্চিত। ভারতে প্রায় ৭০ কোটি লোক কিছু দিন আগেও খোলামাঠে মলমূত্র ত্যাগ করতো। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ‘পরিচ্ছন্ন ভারত’ কার্যক্রম পরিচালনার পর এ সংখ্যা কিছুটা কমে এসেছে। খোলামাঠে মলমূত্র ত্যাগ করতে গিয়ে অনেক মেয়ে ধর্ষণের শিকার হয়েছে। ঘরে বা ঘরের পাশে শৌচাগার নির্মাণ করে না দেয়ার কারণে ভারতের এক স্কুলছাত্রী অনশন পর্যন্ত করেছিল। এক্ষেত্রে ভারত, পাকিস্তান, নেপাল প্রভৃতি পার্শ্ববর্তী দেশের তুলনায় বাংলাদেশের অবস্থা অনেক উন্নত। কিছুদিন পূর্বেও বাংলাদেশে ৪ ভাগ লোক খোলামাঠে মলমূত্র ত্যাগ করত, এখন তা এক ভাগে নেমে এসেছে। কিন্তু ভারতে খোলামাঠে মলমূত্র ত্যাগ অধিকাংশ লোকের জীবনাচারের অন্তর্ভুক্ত হয়ে দাঁড়িয়েছে। সরকার নিজ খরচে টয়লেট নির্মাণ করে দেয়ার পরও ভারতের লোকজন অভ্যাসবশত: খোলামাঠে মলমূত্র ত্যাগে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। ভারতের মানুষদের সচেতন করতে তাই নির্মিত হয়েছে ‘টয়লেট : এক প্রেম কথা’ সিনেমা। এই সিনেমাটি শতাধিক কোটি টাকা আয়ও করেছে। শ্বশুরবাড়িতে শৌচাগার না থাকায় তার শাশুড়ি টয়লেট করতে খোলামাঠে যেতে বললে ১৯ বছরের নায়িকা প্রিয়াঙ্কা বিদ্রোহ করে বাপের বাড়ি চলে যায়। এই বিদ্রোহই সিনেমার উপজীব্য। ভারতের ৫০ ভাগ লোকের খোলামাঠে শৌচকর্ম করার সামাজিক সমস্যাকে দর্শকের জন্য সিনেমাটিতে উপভোগ্য করে তোলা হয়েছে।

খোলামাঠে মলমূত্র ত্যাগের পরিমাণ কম হলেও বাংলাদেশে টয়লেটের মান উন্নত নয়। বর্তমান বিশ্বে টয়লেটের মান দিয়ে লোকের আধুনিকতা ও সভ্যতার মাত্রা পরিমাপ করা হয়। মানুষ কতটুকু সভ্য তা বোঝা যায় তার ব্যবহৃত শৌচাগার দেখে।

রাজধানী ঢাকায় প্রায় দেড় কোটির অধিক লোক বসবাস করে; এর মধ্যে ভাসমান লোক-সংখ্যা নিতান্ত কম নয়। প্রতিদিন ৫০ লাখ মানুষ কাজের তাগিদে বাড়ি থেকে বের হন। এছাড়াও দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অসংখ্য মানুষ রাজধানীতে যাতায়াত করে। কিন্তু বাইর থেকে আসা ও ভাসমান মানুষদের জন্য টয়লেটের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেই। কয়েক বছর আগেও ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে মোট পাবলিক টয়লেটের সংখ্যা ছিল ৬৯টি; শৌচাগারগুলোর মধ্যে ২২টি ছিলো সচল এবং ৪৭টি অচল। অন্যদিকে অধিকাংশ মসজিদের টয়লেট তালামারা থাকে। পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোতে গ্যাস স্টেশনের সঙ্গে খাবার টয়লেটের সুবন্দোবস্ত থাকে। আমাদের দেশে গ্যাস স্টেশনের টয়লেটগুলোর অবস্থা পাবলিক টয়লেটের চেয়েও খারাপ। বাংলাদেশে পর্যটকদের আগমন নেই বলে টয়লেট নির্মাণের চাপ সিটি করপোরেশনের উপর আগেও ছিল না, এখনও নেই। কখনও কখনও প্রকৃতির ডাক তো আর বলে কয়ে আসে না, আসলেই পড়তে হয় বিপদে; তখন বাধ্য হয়েই প্রাকৃতিক কর্মটি উন্মুক্ত স্থানেই সেরে নিতে হয়।

ঢাকা শহরে পুরাতন টয়লেটগুলোর বেহাল অবস্থার কারণে আমাদের সভ্য সমাজের জীব বলে ভাবতে লজ্জা হয়। স্যাঁতস্যাঁতে, ছাদ চুইয়ে পানি পড়া, গাঢ় অন্ধকার, উড়ন্ত মাছি, দুর্গন্ধময় ভাসমান মলমূত্র, জমে থাকা পানি, হাতল ভাঙা বদনা, নষ্ট ট্যাপ, বস্তা টাঙানো দরজা, তার দিয়ে বাঁধা ছিটকিনি ছাড়া দরজা, অপরিচ্ছন্ন কমোড, দেয়াল জুড়ে লেখা অশ্লীল কথাবার্তা- এ চিত্র রাজধানীর ঢাকার প্রায় প্রতিটি পাবলিক টয়লেটের।

লাখ লাখ মানুষের জন্য ব্যবহার-অনুপযুক্ত এ পাবলিক টয়লেটগুলোও আবার প্রয়োজনের তুলনায় একেবারেই কম। নির্মাণের পর বহু বছর সংস্কার না করায় কিছু টয়লেট আপনা আপনিই ব্যবহারের অনুপযোগী। নিয়মিত পরিষ্কার করা, ব্লিচিং পাউডার ছিটানো, হাত ধোয়ার লিকুইড সাবান সরবরাহ কার দায়িত্বে তা খুঁজে পেতে গলদঘর্ম হতে হবে। পুরাতন টয়লেটগুলোতে পানির পাত্র থাকে ভাঙা, নিয়মিত পরিষ্কার করা হয় না; অথচ এইসব টয়লেটের বিনা পয়সার পানি দিয়ে বিভিন্ন লোকের গাড়ি ধোয়া হয়, বোতলে পানি ভরে বিক্রি করার অভিযোগ পাওয়া যায়। পূর্বে নির্মিত টয়লেটগুলোর দুর্গন্ধময় অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের কারণে এবং পর্যাপ্ত টয়লেট না থাকায় ফুটপাতসহ যত্রতত্র প্রস্রাব করতে বাধ্য হচ্ছে পথচারীরা। অন্যদিকে টয়লেটগুলোর অবস্থান সম্পর্কে কোন নির্দেশনা চিহ্ন না থাকায় জনগণের পক্ষে তা খুঁজে পাওয়াও সম্ভব হয় না। অবশ্য শহরের আয়তনের তুলনায় এত স্বল্প সংখ্যক টয়লেটের নির্দেশনা-চিহ্ন ব্যবহারও সম্ভব নয়।

পুরুষদের ব্যবহার উপযোগী পর্যাপ্ত টয়লেটের ব্যবস্থা যে শহরে নেই সেই শহরে নারীবান্ধব, স্বাস্থ্যকর এবং প্রতিবন্ধী মানুষের ব্যবহারের উপযোগী টয়লেটের প্রত্যাশা করা অলিক কল্পনা। পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ও লোকদৃষ্টির অগোচরে স্বতন্ত্র প্রবেশপথ না থাকায় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নারীরা বিদ্যমান পাবলিক টয়লেট এড়িয়ে চলে। পুরুষদের খোলা রাস্তায় টয়লেট কর্ম সম্পাদন করার লজ্জাহীন সংস্কৃতি চালু থাকলেও মেয়েদের পক্ষে তা করা একেবারেই অসম্ভব। ফলে একজন মেয়ে ঘর থেকে বের হয়ে কোন অফিসে গিয়ে টয়লেট করার সুযোগ না পেলে ঘরে না ফেরা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়। এজন্য মেয়েদের কিডনির ওপর চাপ পড়ে। জরুরি প্রয়োজনে মেয়েদের ঘর থেকে বের হতে হলে হয় তাদের কম পানি খেয়ে বের হতে হয় অথবা দ্রুত ফেরত আসতে হয়। অন্যথায় তাদের ঘণ্টার পর ঘণ্টা প্রস্রাবের বেগ আটকে রাখা ছাড়া অন্য কোন উপায় থাকে না। ঈদ-পার্বনে যাত্রা পথে কোন কারণে পথিমধ্যে যানবাহন দীর্ঘক্ষণ থেমে থাকলে সব পুরুষ যাত্রী রাস্তার ধারে সবার সম্মুখে বসে, দাঁড়িয়ে প্রস্রাব করে; মেয়ে যাত্রীদের অবস্থা হয় সঙ্গিন।ফলে মেয়েদের শরীরের বিপাক ক্রিয়া ও রেচন প্রক্রিয়ার ব্যাঘাত ঘটে দীর্ঘ মেয়াদি রোগের জন্ম হতে পারে।
পিরিয়ড চলাকালীন নারীদের সেনিটারী প্যাড পরিবর্তন করার ব্যবস্থা থাকে না।
অথচ দেখা যায় অফিসের বড় কর্তার রুমের সাথে লাগোয়া শৌচাগার রয়েছে। কিন্তু নারী কর্মীদের আলাদা শৌচাগার নেই।

মেয়র মোহাম্মদ হানিফের আমলে ঢাকা শহরে টয়লেট নির্মাণের কাজটি শুরু হয়; কিন্তু তিনি তার প্রকৌশলীদের অসহযোগিতায় পর্যাপ্ত টয়লেট নির্মাণ করে যেতে পারেননি। তার অসমাপ্ত কাজটি নব উদ্যোমে শুরু হয়েছে তারই সন্তান সাইদ খোকন ও প্রয়াত মেয়র আনিসুল হকের আগ্রহে। সিটি করপোরেশনের উক্ত দুই মেয়র নতুন গণশৌচাগার নির্মাণ ও পুরাতনগুলো সংস্কারের উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন। আনিসুল হকের মৃত্যুর পর তার পরিকল্পনা মোতাবেক প্যানেল মেয়রদের নেতৃত্বে কাজ চলছে বলে মনে হয়। বর্তমানে ভাসমান মানুষ ও পথচারীদের ব্যবহারের জন্য ভ্রাম্যমাণ শৌচাগারের ব্যবস্থাও করা হয়েছে। ওয়াটার এইড বাংলাদেশের আর্থিক সহায়তায় নির্মিত এসব মোবাইল টয়লেট ঢাকা শহরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয়, রাজনৈতিক অনুষ্ঠানে ব্যবহার করা হয়। তবে ভ্রাম্যমাণ টয়লেট জনপ্রিয় হয়নি।
দেশের পর্যটন স্পট এবং কর্মস্থলে নারীবান্ধব শৌচাগার নির্মান করা অবশ্যক হয়ে দাড়িয়েছে।

ছৈয়দ আহমদ তানশীর উদ্দীন
নার্স ও পুষ্টিবীদ, কক্সবাজার
syedahmedtanshiruddin@gmail